HAL Russia Passenger Jet Deal: বিশ্বের বিমান পরিবহন শিল্পে বোয়িং (Boeing) এবং এয়ারবাসের (Airbus) মতো সংস্থাগুলির একাধিপত্য রয়েছে। এই আবহে, ভারত একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। সম্প্রতি, রাশিয়ার সাথে অংশীদারিত্বের মাধ্যমে দেশে যাত্রীবিমান তৈরির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। হিন্দুস্তান অ্যারোনটিক্স লিমিটেড (HAL) ভারতে রাশিয়ান SJ-100 সিভিলিয়ান বিমান তৈরি করবে, যা ভারতের বিমান শিল্পের জন্য একটি নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবে।
ভারত-রাশিয়া যুগান্তকারী অংশীদারিত্ব
এই পদক্ষেপটিকে ভারতের অসামরিক বিমান পরিবহন (Civil Aviation) সেক্টরের জন্য একটি ঐতিহাসিক ঘটনা হিসাবে বিবেচনা করা হচ্ছে। হিন্দুস্তান অ্যারোনটিক্স লিমিটেড (HAL) রাশিয়ার PJSC United Aircraft Corporation-এর সাথে একটি সমঝোতা স্মারক (MoU) স্বাক্ষর করেছে। এই চুক্তির অধীনে, ভারতে SJ-100 সিভিলিয়ান কমিউটার প্যাসেঞ্জার এয়ারক্রাফ্ট তৈরি করা হবে।
এই MoU ভারত-রাশিয়া সহযোগিতাকে এক নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাবে। এতদিন পর্যন্ত এই দুই দেশের মধ্যে অংশীদারিত্ব মূলত প্রতিরক্ষা ক্ষেত্র, যেমন সুখোই ফাইটার জেট, ইত্যাদির মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। এই নতুন উদ্যোগের মাধ্যমে ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ (Make in India) কর্মসূচির অধীনে দেশে অসামরিক বিমান তৈরির একটি শক্তিশালী বাস্তুতন্ত্র (ecosystem) গড়ে তোলার লক্ষ্য নেওয়া হয়েছে।
ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট এবং উদ্দেশ্য
এই প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য হলো অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বৃদ্ধি করা এবং ভারতের ‘উড়ান’ (UDAN – Ude Desh ka Aam Nagrik) প্রকল্পকে সমর্থন করা, যার লক্ষ্য আঞ্চলিক সংযোগ বৃদ্ধি করা। উল্লেখযোগ্যভাবে, প্রায় চার দশক পর এটি ভারতের প্রথম বড় অসামরিক বিমান উৎপাদন চুক্তি।
শেষবার HAL একটি অসামরিক বিমান তৈরির সাথে যুক্ত ছিল ১৯৮৮ সালে, যখন ব্রিটেনের সাথে অংশীদারিত্বে Avro HS 748 বিমান তৈরি করা হয়েছিল। তারপর থেকে, ভারতের মনোযোগ সম্পূর্ণরূপে প্রতিরক্ষা বিমান তৈরির দিকে চলে যায়। তাই, SJ-100 প্রকল্পটি ঐতিহাসিকভাবে তাৎপর্যপূর্ণ, কারণ এর মাধ্যমে ভারত ৪০ বছর পর পূর্ণাঙ্গভাবে সিভিল জেট বিমান উৎপাদনে পুনরায় প্রবেশ করছে।
SJ-100 বিমান সম্পর্কে খুঁটিনাটি
এই চুক্তির কেন্দ্রবিন্দুতে থাকা বিমানটি হলো সুখোই সুপারজেট 100 (SJ-100)। আসুন বিমানটি সম্পর্কে কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য জেনে নেওয়া যাক।
| বৈশিষ্ট্য | বিবরণ |
|---|---|
| **ধরণ (Type)** | এটি একটি টুইন-ইঞ্জিন, ন্যারো-বডি, স্বল্প থেকে মাঝারি পাল্লার আঞ্চলিক জেট। |
| **ব্যবহার (Primary Use)** | এটি মূলত অভ্যন্তরীণ যাত্রার (domestic travel) জন্য ডিজাইন করা হয়েছে। |
| **আসন সংখ্যা (Capacity)** | অভ্যন্তরীণ কনফিগারেশনের উপর নির্ভর করে ৮৭ থেকে ১০৩ জন যাত্রী বহন করতে পারে। |
| **রেঞ্জ (Range)** | এর ফ্লাইট রেঞ্জ প্রায় ৩,০০০ থেকে ৪,৫০০ কিলোমিটার, যা ভারতের শহরগুলিকে সংযুক্ত করার জন্য আদর্শ। |
| **ইঞ্জিন (Engine)** | পূর্বে রাশিয়া এবং ফ্রান্সের যৌথভাবে তৈরি SM146 ইঞ্জিন ব্যবহার করা হত। কিন্তু আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞার কারণে রাশিয়া এখন নিজস্ব দেশীয় PD-8 ইঞ্জিন ব্যবহার করছে, যা নতুন মডেলগুলিতে থাকবে। |
| **ট্র্যাক রেকর্ড (Track Record)** | বিশ্বের ১৬টিরও বেশি এয়ারলাইন্সে ২০০টির বেশি SJ-100 বিমান ইতিমধ্যেই পরিষেবা দিচ্ছে। |
প্রকল্পের যৌক্তিকতা এবং সম্ভাবনা
এই অংশীদারিত্বের পিছনে বেশ কিছু কৌশলগত লক্ষ্য এবং বাজারের বাস্তবতা কাজ করছে।
- কৌশলগত শিল্প দৃষ্টি (Strategic Industrial Vision): এই প্রকল্পটি ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ এবং ‘আত্মনির্ভর ভারত’ উদ্যোগের সাথে সম্পূর্ণ সামঞ্জস্যপূর্ণ। এটি HAL-কে প্রতিরক্ষা প্রকল্পের বাইরে তার পোর্টফোলিও প্রসারিত করার সুযোগ দেবে।
- বাজারের সম্ভাবনা (Market Potential): HAL-এর অনুমান অনুযায়ী, আগামী ১০ বছরে দেশে ২০০-২৫০টি আঞ্চলিক জেটের প্রয়োজন হবে। পার্শ্ববর্তী দেশগুলিতে (নেপাল, ভুটান, বাংলাদেশ) আরও ৩০০-৩৫০টি বিমানের চাহিদা রয়েছে। ছোট শহরগুলিকে সংযুক্ত করার জন্য SJ-100 একটি আদর্শ বিমান।
- অর্থনৈতিক ও কর্মসংস্থান বৃদ্ধি: এই উৎপাদন প্রকল্পের ফলে হাজার হাজার কর্মসংস্থান তৈরি হবে বলে আশা করা হচ্ছে। এর সাথে রাশিয়ার কাছ থেকে প্রযুক্তি হস্তান্তরও (transfer of technology) হবে, যা ভবিষ্যতে ভারতকে আরও উন্নত বিমান তৈরিতে সক্ষম করে তুলতে পারে।
কৌশলগত তাৎপর্য
এই চুক্তির প্রভাব সুদূরপ্রসারী।
- অসামরিক বিমান পরিবহনে মাইলফলক: ভারত পুনরায় অসামরিক বিমান প্রস্তুতকারক দেশ হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করবে।
- ভারত-রাশিয়া সহযোগিতা: একটি নতুন কৌশলগত অসামরিক ক্ষেত্রে দুই দেশের সম্পর্ক আরও গভীর হবে।
- ‘উড়ান’ স্কিমকে সমর্থন: এই বিমান Tier-2 এবং Tier-3 শহরগুলির সাথে সংযোগ বাড়ানোর জন্য অত্যন্ত উপযুক্ত।
- ভূ-রাজনৈতিক প্রাসঙ্গিকতা: এটি ভারতকে বোয়িং এবং এয়ারবাসের মতো পশ্চিমা নির্মাতাদের উপর নির্ভরতা কমাতে সাহায্য করবে।
চ্যালেঞ্জ এবং উদ্বেগ
এই প্রকল্প ঘিরে যথেষ্ট আশার সঞ্চার হলেও, এর সামনে বেশ কিছু বাধাও রয়েছে।
- নিয়ন্ত্রক অনুমোদন (Regulatory Approval): অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের জন্য HAL-কে ডিরেক্টরেট জেনারেল অফ সিভিল এভিয়েশন (DGCA)-এর অনুমোদন নিতে হবে।
- সরবরাহ শৃঙ্খলের ঝুঁকি (Supply Chain Risks): মূল SJ-100 বিমানটি অনেক পশ্চিমা ইলেকট্রনিক যন্ত্রাংশের উপর নির্ভরশীল ছিল। নিষেধাজ্ঞার কারণে, ভারতকে রাশিয়ার সাথে একটি নতুন সরবরাহ শৃঙ্খল তৈরি করতে হবে।
- বাজারের গ্রহণযোগ্যতা (Market Acceptance): IndiGo এবং Air India-র মতো ভারতীয় বিমান সংস্থাগুলিকে SJ-100 কেনার জন্য রাজি করানো একটি বড় চ্যালেঞ্জ হবে, কারণ তাদের কাছে ইতিমধ্যেই Airbus এবং Boeing-এর প্রমাণিত মডেলের বিশাল অর্ডার রয়েছে।
- প্রকৃত স্থানীয়করণ (True Localization): প্রকল্পটি তখনই সত্যিকারের ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ সাফল্য পাবে যখন কেবল রাশিয়ার যন্ত্রাংশ একত্রিত না করে, ভারতেই যন্ত্রাংশ তৈরি করা হবে।
